Saturday, December 31, 2016

একটু হাত বাড়ালেই ওরা অনেক দূর যাবে



আজ প্রথম আলোর প্রথম পাতায় ছাপা হয়েছে দেবযানী ঘোষের সব বাধা পেরিয়ে এগিয়ে যাওয়ার কাহিনি। সত্যিই অনুপ্রাণিত হওয়ার মতো একটি খবর। সমাজের নানা বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে একটি মেয়ের এভাবে এগিয়ে যাওয়া সত্যিই আমাদের মনে আশা জাগায়। লক্ষ্য ঠিক থাকলে যে তা অর্জন করা যায়, দেবযানী ঘোষ তা দেখিয়ে দিয়েছেন। ব্যাচেলরস শেষ করে একা বাইরে পড়তে গিয়েছেন। সমাজের ভ্রুকুটি ছিল। সেটা উপেক্ষা করেছেন।

দেবযানীর ভাগ্য ভালো। পরিবার ছিল তাঁর পাশে। তাঁর মা সব সময় বলতেন, ‘লোকের কথায় কান না দিয়ে সামনে অনেক দূর এগিয়ে যাও।’ তবে সবাই দেবযানীর মতো ভাগ্যবান নয়। পরিবারের সহায়তা ও সমর্থন পায় না বলেই আমাদের দেশে বেশির ভাগ মেয়ে এগিয়ে যেতে পারে না। পরিবারের অসহযোগিতার কারণে অনেক মেয়ের পড়ালেখা মাঝপথে এসে বন্ধ হয়ে যায়। আবার কেউবা যদিও পড়ালেখাটা শেষ করলেন, মানে মাস্টার্স পাস করলেন, কিন্তু এরপর আর তাঁদের কিছু করা—যেমন: চাকরি, ব্যবসা বা উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়া—হয় না। কারণ, সেই মেয়েটির পরিবার মনে করে না যে এসব করার আর কোনো দরকার আছে। বরং একটি ভালো বিয়ে হলেই মেয়েদের জন্য ভালো। আমাদের সমাজে এ রকম পরিবারের সংখ্যাই বেশি।
কয়েক দিন আগেই পত্রিকার পাতায় ছাপা হয়ে সাহসী মেয়ে শারমিনের গল্প। মায়ের হঠকারী সিদ্ধান্তের কারণে তার জীবনটা প্রায় নষ্ট হতে যাচ্ছিল। ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার সত্যনগর গ্রামের কবির হোসেনের মেয়ে শারমিন। ২০১৫ সালে নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় মা গোলেনূর বেগম শারমিনের বিয়ে ঠিক করেন প্রতিবেশী এক ছেলের সঙ্গে। শারমিন মায়ের এই সিদ্ধান্তে রাজি না হওয়ায় নানাভাবে তার ওপর চাপ প্রয়োগ করা হয়। এরপর না পেরে তাকে আটকে রাখা হয়। পরে সহপাঠীর সহায়তায় শারমিন পালিয়ে আসে। এখন দাদির তত্ত্বাবধানে থেকে পড়ালেখা করছে সে।
কিন্তু কজন মেয়েই বা পারে এভাবে মা-বাবার অবাধ্য হয়ে নিজের লক্ষ্যপূরণের পথে এগিয়ে যেতে? বেশির ভাগ মেয়েই পারে না। মা-বাবার ইচ্ছার কাছে বলি হচ্ছে তারা। হচ্ছে বাল্যবিবাহের শিকার। অল্প বয়সে মা হচ্ছে। এরপর সংসারের ঘানি টানতে টানতে জীবন পার করে দেওয়া। কিছুই আর করা হয় না। সমস্ত সম্ভাবনা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়।
আমাদের সমাজে একটি মেয়েকে যত বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়, ততটা একটি ছেলেকে হতে হয় না। কারণ, পরিবার ও সমাজ তার পাশে থাকে। আসলে নারী-পুরুষের বৈষম্যটা শুরুই হয় পরিবার থেকে। মা-বাবাই এ ধারণার প্রাথমিক শিক্ষক। এরপর আছে আত্মীয়স্বজন আর প্রতিবেশী। মেয়েদের বেশি পড়ালেখা করিয়ে কী হবে। সেই তো ঘর-সংসারই করতে হবে। এ জন্য বিয়ে দিয়ে দেওয়াই ভালো। কিন্তু এসব ধ্যানধারণা থেকে সবাইকে বের হয়ে আসতে হবে।
শারমিনের মায়ের মতো মা হয়ে কোনো লাভ নেই, বরং দেবযানীর মায়ের মতো বা দীপারানীর মায়ের মতো মা হোন। দীপারানীর মা প্রতিদিন এক মুষ্টি করে চাল জমাতেন ও কাঁথা সেলাই করতেন। সেই জমানো চাল বিক্রির অর্থ ও কাঁথা সেলাইয়ের মজুরি দিয়ে মেয়ে দীপার পড়ালেখার খরচ চালিয়েছেন তিনি। ফলও পেয়েছেন। ২০১৫ সালে দীপারানী ফরিদপুরের কানাইপুর উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে।
একটু উৎসাহ আর উদ্দীপনা মেয়েদের কত দূর নিয়ে যেতে পারে, এর প্রমাণ তো দেবযানী রেখেছেন। দীপারানী তার লক্ষ্যপূরণের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। মেয়েদের উদ্দেশে বলছি, সবাজে বাধা বিপত্তি থাকবেই। কিন্তু এসব বাধা ডিঙাতে হবে। দেবযানী বলেছেন, ‘সুবিধা না পাওয়ার অজুহাত দিয়ে নিজেকে থামিয়ে দেওয়া চলবে না।’ সব মেয়ে দেবযানীর এই কথাকে আপ্তবাক্য হিসেবে মেনে নিয়ে এগিয়ে যাক তাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের দিকে—এটাই আমাদের চাওয়া। দেবযানীর মতো সব মেয়ে বলুক, ‘আমিও পারি।’

No comments:

Post a Comment

Sponsor