হালে আরিফের কিছু টাকা হয়েছে, তাই চেনাপরিচিত সবাই এখন তার তারিফে
মশগুল। যেন আরিফের মতোন ভাগ্যবান ও বুঝমান মানুষ আর হয় না। ঢাকায় টাকা ওড়ে,
জাস্ট মওকা বুঝে ধরে ফেললেই হয়! আরিফের এলেম আছে, তাই ও ধরতে পেরেছে। টাকা
হলে মানুষের কতো কিছুই না হয়! যশ, খ্যাতি, প্রতিপত্তি, লোকের সাথে টক্কর
দেবার ক্ষমতা- সব হাতের মুঠোয় এসে যায়। এমনও শোনা যায়, ইদানীং নাকি মেলা
টাকা খরচ করলে তেল-চকচকে টাকও ঢাকে। টাকার কী মহিমা বলুন!
টাকাটা আরিফের হাতে কীভাবে এলো, ওটা কোনো জুতসই প্রশ্ন নয়। কথায় বলে, এন্ড
জাস্টিফাইস দ্য মিন্স। অর্থাত্ গোলই আসল। ওটা ডান পায়ে কি বাঁ-পায়ের শট
থেকে এলো, সেটা কোনো ধর্তব্যের বিষয় নয়। গোল হয়েছে, টিম জিতেছে। ব্যস,
জোরসে তালিয়া বাজাও। দর্শক-সমর্থক সকলকে ডেকে নিয়ে ভরপেট মিষ্টিমুখ কর।
তামার বিষ বলে একটা কথা আছে। আরিফের হাতে অঢেল টাকা এল বটে, ফলে তার
স্বভাব-চরিত্তি সব রসাতলে গেল। ধরাকে সে এখন নেহাতই সরা জ্ঞান করতে লেগেছে।
মানুষকে মানুষ মনে করে না, সবার সঙ্গে যাচ্ছেতাই ব্যবহার করে। যেন টাকা
দিয়ে তামাম দুনিয়া কিনে নেওয়া যায়। টাকার গরমে ওর বড্ড পায়াভারি, যাকে বলে
আঙুল ফুলে কলাগাছ। আরিফকে এখন আর ছুঁয়ে দেখার উপায় নেই, সে শূন্যে পা তুলে
হাঁটে। সোজা চোখে তাকায় না, আরিফের চোখের কোণে স্পষ্ট তাচ্ছিল্যের ভাব ফুটে
ওঠে।
এহেন আরিফ মেলা টাকা দিয়ে একখানা গাড়ি কিনেছে, কিন্তু
গাড়ির শুল্ক পরিশোধ করতে তার ভীষণ আপত্তি। আজব যুক্তি তার- টাকা দিয়ে গাড়ি
কিনব, সরকারের মুখ উজ্জ্বল হবে, আবার পকেট থেকে টাকা খসিয়ে ট্যাক্সও দিব! এ
ভীষণ অন্যায়।
ইনকাম ট্যাক্স দিতেও তার মন সরে না। কারণ
সরকার নিজেই বলেছে আয়কর মানে আর্ন মানি। আয় করলে দেশের সঞ্চয় বাড়বে।
সার্বিক উন্নয়ন হবে, তাতে আয়কর কেন দেব! তার মোটা টাকার হদিসে সরকারের কী
দরকার!
সুইসব্যাংকেও মেলা টাকা জমা পড়েছে আরিফের। শোনা
যায়, সেখানে টাকা রাখা আর ভাগাড়ে ময়লা ফেলা সমান কথা। সুইসব্যাংকে টাকা
ঢোকানো যত সহজ, তোলা তত সহজ নয়। তুলতে গেলেই নাকি সুইস কর্তৃপক্ষ অর্থের
শিকড় ধরে হ্যাঁচকা টান দেয়। কার টাকা, কিসের টাকা, কীভাবে এল, কেন এল
ইত্যাকার সব প্রশ্ন জানতে চায়। আরিফের মতোন যারা মেলা টাকার মালিক, তারা কি
আর হিসাব করে টাকা জমায়! অর্থের শিকড় বিষয়ে জুতসই জবাব দিতে না পারলেই
অনর্থ ঘটে। সুইসব্যাংক টাকার পাহাড় দেয় আটকে। কখনো কখনো নাকি ফটকেও পোরে
টাকার মালিককে।
আরিফের টাকা আছে বটে, তবে সে হাড়কেপ্পন।
চাইতে গেলে বলে, টাকা হলো হাতের ময়লা। এই আছে এই নেই। আজকে আমির তো কাল
ফকির। তাই টাকা চেয়ে আমাকে মিছে লজ্জা দিও না! প্রাণ থাকতে আমি টাকা নিয়ে
নয়ছয় করতে পারব না। টাকাই জীবন, টাকাই মরণ। প্রয়োজনে আমি আণ্ডিল আণ্ডিল
টাকার বাণ্ডিল বানিয়ে কবরে নিয়ে যাব, তাও এ জিনিস হাতছাড়া করব না।
টাকার গরম আর প্রেমের শরম নাকি লুকিয়ে রাখা যায় না। আরিফও এখন কথায় কথায়
বারফট্টাই করতে ছাড়ে না। হেন করেঙ্গা তেন করেঙ্গা, টাকা দিয়ে ঘুড়ি বানিয়ে
আসমানে উড়াউঙ্গা- এসব বলতে গেলে তার গত্বাঁধা কথা। কিন্তু আরিফ জানে না,
টাকা কামানোর চেয়ে খরচ করা কঠিন। খরচ মানে সদ্ব্যবহার। নষ্ট করতে চাইলে
অবশ্য হাজারটা উপায় আছে। সৈয়দ মুজতবা আলী যথার্থই বলেছেন, জ্ঞানীর টাকা
ধনীর টাকার চেয়ে উত্কৃষ্টতর। একজন জ্ঞানীলোক জানেন, কীভাবে টাকার সর্বোত্তম
ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়। কিন্তু মূর্খ তা জানে না। বরং সে টাকার অপচয়
করেই অভ্যস্ত।
আরিফ কাঁচা টাকার উসকানিতে এখন সবার সঙ্গে
ঠাট্টা-টিটকিরি করে বেড়ায়, যত্রতত্র পপকর্ণের মতো বাণী ছড়ায়। এতে
পাড়া-প্রতিবেশীর গা জ্বলে, আরিফ ওটা মনপ্রাণ ভরে উপভোগ করে। টাকার সবচে বড়
দুর্বলতা কোথায় জানেন, টাকা মনুষ্যত্ব হরণ করে। টাকা মানুষকে একাকীত্ব
উপহার দেয়। খুব কম লোকই আছে যারা কিনা টাকার গরমটা নিজের ভিতরে শুষে নিতে
জানে। বেশিরভাগই ওটা উগরে দেয়, ফলে বমনক্রিয়ার মতো দুর্গন্ধ ছড়ায়, তাতে
পরিবেশ নষ্ট হয়।
লন্ডনে পড়তে গিয়ে এক সফল মানুষের সঙ্গে
আলাপ হয়। জাতে বাঙালি, কিন্তু তিনি মননে বিশ্বজনীন। মৃদু হেসে বললেন, বুঝলে
ভায়া, আমরা আসলে জীবনটাকে বুঝতে শিখিনি। মিছেই টাকার পেছনে ছুটি। তারপর
তিনি এক অদ্ভুত কথা বললেন। মানি দ্যাট ইউ স্পেন্ড ইজ ইওর মানি। মানে হলো
কিনা অর্থের অর্থপূর্ণ ব্যবহারেই এর কৃতিত্ব বা মহত্ত্ব নিহিত। যে টাকা
তোমার কোনো কাজে আসবে না, ওটা তোমার টাকাই নয়। হয় তোমার উত্তরাধিকারী খাবে,
চোর-ডাকাত বা সরকার নিয়ে নেবে। তুমি তার ফললাভ করবে না। তাই মিছে কেন
টাকার পেছনে ছোটা!
ভেবে দেখলাম, বেড়ে বলেছেন বটে। বেশি টাকা
শুধু গরমই দেয়, কামাতে গিয়ে মিছে ঘাম ঝরায়, মাঝেমাঝে মান-ইজ্জতও যায়,
কিন্তু বাস্তবে খুব একটা কাজে আসে না। এই কথা আরিফকে বলতেই সে রে রে করে
তেড়ে এল। তেঁতো গলায় বলল, আমার টাকার পাহাড় দেখে তোমার বুঝি খুব ঈর্ষা
হচ্ছে! তাই বাড়িয়ে এসে জ্ঞান দিচ্ছ, তাই না! আমি দ্বিধা-সঙ্কোচ ঝেড়ে বলি,
কেন বাপু, দেশের জন্য কিছু করার নেই? এ দেশ তোমাকে আশ্রয় দিয়েছে, মাটি
দিয়েছে, ফসল ফলাচ্ছ, রাস্তাঘাটে শাঁই শাঁই করে গাড়ি ছোটাচ্ছ- বিনিময়ে কিছু
দেবে না! ফিবছর কত রকমের অবকাঠামো নির্মাণ, গ্যাস-বিদ্যুত্-পানি ও
পয়ঃনিষ্কাশনের আয়োজন করছে, টাকাটা কে দেবে শুনি, গৌরী সেন!
একগুঁয়ে আরিফ আমার কোনো কথা মানবে না। চোরে যেমন শোনে না ধর্মের কাহিনি।
তার সাফ কথা, এত কষ্ট করে আয় করছি কি আয়কর দেবার জন্য! দাম দিয়ে গাড়ি
কিনেছি, এই ঢের। এতে জাতির সম্মান বেড়েছে। আবার শুল্ক-কর কেন! আমি জলদি
নিষ্ক্রান্ত হই। বুঝে ফেলি, এই জেগে ঘুমানো পাবলিকের ঘুম ভাঙানো আমার কম্মো
নয়। এর জন্য অন্য ব্যবস্থা আছে। ওটা করতে হবে।
No comments:
Post a Comment