Sunday, January 8, 2017

দিল্লি এখনো অনেক দূরে


চতুর্দশ শতকের খ্যাতনামা সুফিসাধক হজরত নিজামউদ্দিনকে দিল্লির শাসক ফিরোজ শাহ তুঘলক ‘সুলতান আল মাশায়েখ’ বা সুফিসম্রাট নামে অভিহিত করেছিলেন। নিজামউদ্দিনের জীবনকালে ১৪ জন শাসক দিল্লির মসনদে বসেছেন। তিনি কখনোই ওই শাসকদের পরোয়া করেননি, কোনো দানও গ্রহণ করেননি।

 একপর্যায়ে সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলক তাঁর ওপর খুবই খেপে যান। সুলতান তখন বাংলাদেশে একটা অভিযানে ছিলেন। তিনি বার্তা পাঠালেন, তিনি ফেরার আগেই নিজামউদ্দিন যেন দিল্লি ছেড়ে চলে যান। নিজামউদ্দিনের সঙ্গীসাথিরা ভয় পেলেন, হজরতকে পরামর্শ দিলেন, সুলতান এসে পড়ল বলে, তাড়াতাড়ি সরে পড়ুন। হজরত তাঁর সাথিদের শান্ত থাকতে বলে উচ্চারণ করেন সেই বিখ্যাত বাক্যটি—হনুজ দিল্লি দূরঅস্ত (দিল্লি এখনো অনেক দূরে)।
প্রযুক্তির কল্যাণে ঢাকা থেকে উড়ালপথে দুই ঘণ্টায় দিল্লি যাওয়া যায়। দিল্লি কি আসলেই এত কাছে? দৃশ্য ও অদৃশ্য হাতের টানাটানিতে দূরত্বটা যেন বেড়েই চলেছে।


পাকিস্তান আমলে একটা দীর্ঘ সময় ধরে আমাদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা ছিলেন ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান। তিনি মনে করতেন, ‘বাঙালিরা খাঁটি মুসলমান নয়। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হিন্দু ভারত সব সময় ষড়যন্ত্র করছে। বাঙালিরা প্রায় সবাই ভারতের দালাল।’ ১৯৬৭ সালের ৭ সেপ্টেম্বর আইয়ুব খান তাঁর ডায়েরিতে লিখেছিলেন, ‘এমন প্রতিবেশী (ভারত) জুড়ে দিয়ে খোদা আমাদের সঙ্গে নিষ্ঠুর আচরণ করেছেন।’
১৯৭১ সালে আমরা পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ বানিয়েছি। তারপর পেরিয়ে গেছে সাড়ে চার দশক। ভারত সম্পর্কে আমাদের অনেকেরই প্রশ্ন, ‘এমন নিষ্ঠুর প্রতিবেশী কেন আমরা পেলাম?’ বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের চড়াই-উতরাই নিয়ে রীতিমতো একটা মহাকাব্য লিখে ফেলা যায়।
এ দেশে ভারতবিরোধিতার স্বরূপ এক ও অবিভাজ্য নয়। কেউ কেউ মনে করেন ভারত একটি ‘হিন্দু রাষ্ট্র’, এ কারণে তারা ভারতের ওপর গোস্বা। আবার নানাভাবে ভারত বাংলাদেশকে চাপে রাখতে চায়, এ জন্য এ দেশের একটা বড় জনগোষ্ঠী ভারতের ওপর ক্ষুব্ধ। ১৯৭৩ সালে জাসদ-সমর্থিত দৈনিক গণকণ্ঠ পত্রিকায় একটা সম্পাদকীয় ছাপা হয়েছিল। শিরোনাম ছিল, ‘ভারতবিরোধিতা নয়, শোষণবিরোধিতা’। জাসদকে এ দেশের পিকিংপন্থী দলগুলো ‘ভারতের দালাল’ বলে যতই গালমন্দ করুক না কেন, ভারত যে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে স্বয়ম্ভর হওয়ার পথে নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করছে, তার উদাহরণ এ দেশের ডান-বাম অনেক রাজনীতিবিদই দিয়ে থাকেন। প্রশ্ন হলো, কথাটা কি সত্য, না অপপ্রচার?
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ও টানাপোড়েন নিয়ে আলোচনা করতে গেলে সংকটে পড়তে হয়। এ যেন শাঁখের করাত। দুই দিক দিয়েই কাটে। ভারতবিরোধিতা এ দেশে সাম্প্রদায়িকতা উসকে দেয়। অন্যদিকে ভারতপ্রেমকে দেখা হয় নির্ভেজাল দালালি হিসেবে। আপনি যদি ভারতের প্রশংসা করে একটা কথা বলেন, অনেকেই আপনাকে দালাল, নতজানু বলে নিন্দা করবে। কেউ কেউ এক পা বাড়িয়ে বলবে, ব্যাটা নিশ্চয়ই ভারতীয় দূতাবাস থেকে নিয়মিত ‘খাম’ পায়। আবার আপনি যদি ভারতের সমালোচনা করেন, আপনাকে বলা হবে যে আপনি বন্ধুরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্টের ষড়যন্ত্র করছেন। অথবা আপনি পাকিস্তানের এজেন্ট। আমার তো মনে হয়, ঈশা খাঁ বেঁচে থাকলে দিল্লির সেনাপতি মানসিংহের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অপরাধে তাঁকেও আইএসআইয়ের চর বানিয়ে দেওয়া হতো।
ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কে গুণগত পরিবর্তন আসবে—এ রকম একটা আকাঙ্ক্ষা ছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়। দুঃখজনক হলেও সত্য যে আমাদের ইচ্ছা পূরণ হয়নি। বাণিজ্যঘাটতি নিয়ে এ দেশে আমরা অনেকেই অনেক কথা বলি। এটা আমার কাছে বড় কোনো সমস্যা না। ভারত না হয়ে চীন যদি আমাদের প্রতিবেশী হতো, তাহলে বাণিজ্যঘাটতি হতো হয়তো তিন গুণ। কেননা, চীনে তৈরি পণ্য দামে সস্তা এবং গুণে-মানে ভালো।
তবে অভিন্ন নদীগুলোর পানি বণ্টন নিয়ে পানি যে পরিমাণ ঘোলা হয়েছে, তার ফলে এ দেশের সাধারণ মানুষের কাছে ভারত এখন মূর্তিমান আতঙ্ক। আমাদের পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর কৃষকেরা শুকনো মৌসুম এলেই চাতক পাখির মতো আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন। কেননা, বৃষ্টিই একমাত্র ভরসা। নদী দিয়ে পানি আসবে কি না, তা তো নির্ভর করে দিল্লির মর্জির ওপর।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সরকার গঠন করা হলো। আমরা আশায় বুক বাঁধলাম। মনে হলো, সম্পর্কের বরফ গলছে। ২০১১ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লি সফরে গিয়েছিলেন। ওই সময় আমি ওই শহরেই ছিলাম। ভারতের গণমাধ্যমে এ নিয়ে তেমন হইচই হয়নি। ওদের চোখে আমরা এত ছোট যে ওদের নজরে তেমন পড়ি না। তবে ঢাকায় অনেকেই আশা করছিলেন পানি বণ্টন নিয়ে একটা সুরাহা হবে। আলোচনার টেবিলে ছিল তিস্তা। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ফিরতি সফরে যখন ঢাকায় এলেন, সব প্রস্তুতি ঠিকঠাক থাকা সত্ত্বেও তিস্তা নিয়ে কোনো চুক্তি হলো না। আমাদের আশার বেলুনটা হঠাৎ করেই ফুটো হয়ে গেল। মনমোহনজি বিব্রত হলেন। আমরা হতাশ হলাম। পশ্চিমবঙ্গের মেঠো রাজনীতির মহাপরাক্রমশালী নেতা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মনে হলো সবকিছু এলোমেলো করে দিলেন। মনমোহন সিং ১০০ কোটি ডলার সাহায্যের ওয়াদা করে ফিরে গেলেন।
বাংলাদেশের চাষবাস এখনো প্রকৃতিনির্ভর। নদীর পানি শুকিয়ে গেলে কৃষকের আত্মা শুকিয়ে যায়। অনেকেই যুক্তি দেন, ভারত একটা ফেডারেল রাষ্ট্র এবং অঙ্গরাজ্যের সম্মতি ছাড়া কেন্দ্রীয় সরকার কোনো সমঝোতা বা চুক্তি করতে পারে না। পাশের রাজ্য সিকিমে একাধিক বিদ্যুৎ ও সেচ প্রকল্পের জন্য তিস্তার পানি সরিয়ে নেওয়ার কারণে পশ্চিমবঙ্গে পানির ঘাটতি দেখা দিয়েছে—এ রকম একটা ব্যাখ্যা আমরা শুনে থাকি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সিকিমের বিরুদ্ধে কখনো হুংকার দিয়েছেন বলে শুনিনি। পানি নিয়ে তাঁর যত শরিকানা বিবাদ, তা হলো বাংলাদেশের সঙ্গে।
তিস্তার পানিতে বাংলাদেশ ভাগ বসালে পশ্চিমবঙ্গের উত্তরের জেলাগুলোতে পানির ঘাটতি দেখা দেবে। এই আশঙ্কায় মমতা বাংলাদেশের ব্যাপারে মমতাহীন হলেন। ‘জল জাতীয়তাবাদকে’ পুঁজি করে গত বিধানসভার নির্বাচনে উত্তরের জেলাগুলোতে তাঁর দল তৃণমূল কংগ্রেস আগেরবারের চেয়ে বেশি ভোট এবং বেশি আসন পেয়েছে। এটা সহজেই অনুমান করা যায়, মমতা যত দিন পশ্চিমবঙ্গে সরকার চালাবেন, তত দিন তিস্তা দিয়ে শুকনো মৌসুমে বাংলাদেশে পানি ঢুকবে না। এখন আমাদের শুধু অপেক্ষার পালা, ঢাকা কিংবা দিল্লির কাছে কোনো জাদুর কাঠি আছে কি না, যা দিয়ে এই জলজট খুলবে।
বাংলাদেশের তুলনায় ভারত এত বড় ও ক্ষমতাবান যে তারা চাইলে স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠতে পারে। এই আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় তখনই, যখন আমরা পারস্পরিক লেনদেনের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে নীতি ও কর্মকৌশল ঠিক করতে পারব। সে জন্য দরকার দেশপ্রেম, আত্মবিশ্বাস, আত্মসম্মানবোধ ও জাতীয় ঐকমত্য।
১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন দেশের হাল ধরলেন, তখন দেশটা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। আমরা তাঁর নেতৃত্বে উঠে দাঁড়ালাম। বৈশ্বিক রাজনীতির আবর্তে পড়ে আমরা একঘরে হয়ে পড়েছিলাম। বঙ্গবন্ধু প্রায় সব দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক তৈরি করার সক্ষমতা দেখালেন। ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে লাহোরে ইসলামি দেশগুলোর শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিয়ে তিনি দুর্দান্ত সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন। এ নিয়ে দিল্লির অনেকেই নাখোশ হয়েছিলেন। ভারতীয় গণমাধ্যমে সমালোচনা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর লাহোর-যাত্রা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের নীতি থেকে বিচ্যুত ছিল না। এটা ছিল বিচ্ছিন্নতা এড়ানো এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে বিরোধ নিষ্পত্তির একটা কৌশল, যা তিনি তাঁর রাষ্ট্রনায়কোচিত দৃঢ়তা দিয়ে অর্জন করেছিলেন। ফলটা তিনি হাতে হাতেই পেয়েছিলেন। তাঁর সফরের পরপরই এপ্রিলে দিল্লিতে বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি হয়। সব যুদ্ধবন্দী পাকিস্তানে ফিরে যায় এবং সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সদস্য হয়। বঙ্গবন্ধুর পদক্ষেপ ছিল তাঁর জোটনিরপেক্ষ নীতির সঙ্গে সম্পূর্ণ সংগতিপূর্ণ। তাঁর লাহোর যাওয়া নিয়ে মন্ত্রিসভার কয়েকজন সদস্য তাঁকে দিল্লির সঙ্গে একটু কথা বলে নেওয়ার অনুরোধ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি কারও মাখা তামাক খাই না। বাংলাদেশ একটা সার্বভৌম রাষ্ট্র।’
বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর দেশপ্রেম ও আত্মসম্মানবোধ নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। আমি মনে করি, তিনি যথার্থই ‘শেখের বেটি’। ভারতের সঙ্গে জমে থাকা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের যাবতীয় জঞ্জাল তিনি ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে পারবেন, পারস্পরিক সম্মান ও সমতার ভিত্তিতে বন্ধুত্বের বন্ধনটা দৃঢ়তর করতে পারবেন। ইতিমধ্যে তিনি তার প্রমাণও দিয়েছেন।
নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদির ঢাকা সফরের পর শেখ হাসিনার দিল্লি যাওয়াটা ছিল সময়ের ব্যাপার। ডিসেম্বরে যাওয়ার কথা থাকলেও তিনি যাননি। না যাওয়ার একটা আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যাও ছিল। গুঞ্জন ছিল, খালি হাতে ফিরতে হবে বলে হয়তো তিনি দিল্লি সফর পিছিয়ে দিয়েছেন। তিনি ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে যাবেন। গণমাধ্যমের বরাত দিয়ে জানানো হয়েছে, এই সফরে প্রতিরক্ষা, যোগাযোগ, বাণিজ্য, জ্বালানি, মহাকাশসহ বিভিন্ন খাতে প্রায় ২০টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সইয়ের জন্য চূড়ান্ত করা হচ্ছে।
চীনের প্রেসিডেন্টের ঢাকা সফর, স্মরণকালের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ ও ঋণের ব্যাপারে চীনের প্রতিশ্রুতি এবং বাংলাদেশকে নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ক্রমবর্ধমান আগ্রহের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফর হবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা কতটুকু পাব এবং কী হারাব, তা নিয়ে গুঞ্জন আছে প্রচুর। বাংলাদেশ নিয়ে ভারত-চীন দ্বৈরথ আমাদের জন্য যতটা আশঙ্কার, ততটাই সম্ভাবনার। আমরা দুই তরফের কাছেই নিজেদের প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে উপস্থাপন করতে পারি, যদি আমরা নিজেদের অবস্থান মজবুত রাখি, দর-কষাকষির ক্ষমতা না হারাই।
দিল্লি নিয়ে আমাদের শঙ্কা হাজার বছরের পুরোনো। কথায় বলে, দিল্লির লাড্ডু খেলেও পস্তাতে হয়, না খেলেও। অপরিবর্তনীয় প্রতিবেশীর সঙ্গে চিরস্থায়ী শত্রুতা কোনোমতেই কাম্য হতে পারে না। বন্ধুত্বের আচ্ছাদনে নিজেদের সম্মান সঁপে দেওয়ার জন্য এত প্রাণ বলি দিয়ে আমরা দেশটা স্বাধীন করিনি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বন্ধুত্বের যে ভিত তৈরি হয়েছিল, তাকে আরও মজবুত করতে হবে এবং একই সঙ্গে আমাদের অগ্রযাত্রায় তাদের নিঃশর্ত সমর্থনও নিশ্চিত করতে হবে। আমরা আশায় থাকব, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফর শুভ ও সফল হবে। আর তা যদি না হয়, তাহলে হজরত নিজামউদ্দিনের কথাই ঘুরেফিরে মনে পড়বে—দিল্লি এখনো অনেক দূরে।
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক।

No comments:

Post a Comment

Sponsor