দল জিতলে ঐক্যের জয়গান ওঠে। সিনিয়র-জুনিয়র সবাই মিলে
ঐক্যবদ্ধ বলেই তো এমন সাফল্য! আবার দল হারলে অদৃশ্য কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে
যেতে হয় অনেক সিনিয়র ক্রিকেটারকে। যদিও দিন শেষে এই জ্যেষ্ঠতা বা নবীনত্ব
দিয়ে দলের কৃতিত্বকে কখনো মাপা যায় না।
মাশরাফি-মুশফিক-তামিম এই তিন ক্রিকেটার কখনো সংবাদ
সম্মেলনে, কখনো ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় এই সিনিয়র-জুনিয়র ব্যাপারটি নিয়ে
কথা বলতে বিরক্তিবোধ করেন। তাঁদের কথা, সবাই মিলেই একটি দল।
সেখানে
জ্যেষ্ঠদের দায়িত্ববোধটা বড়, আবার জ্যেষ্ঠদের দেখিয়ে দেওয়া পথে এগিয়ে
আসতে হবে কনিষ্ঠদের। এ কাজটি ঠিকঠাক হচ্ছে বলেই বাংলাদেশের ক্রিকেটের
উন্নতির লেখচিত্র ঊর্ধ্বমুখী, এমনটাই বিশ্বাস করেন মাশরাফি। এর আগে মুশফিক,
সাকিব, তামিমও বলেছেন এমন কথাই। দলের সবচেয়ে সিনিয়র মাশরাফি থেকে নবীনতম
মোসাদ্দেক-মিরাজ—কী দারুণ ঐকতান এখানে!
আবার সৌম্য-মিরাজ, সাব্বির বা তাসকিনও শ্রীলঙ্কা সফরে নানা
সময়ে বলেছেন, বড়দের কাছ থেকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত হচ্ছেন বলেই সাফল্য
পাচ্ছেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। এই তো ২৫ মার্চ, রণগিরি ডাম্বুলা
আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে ওয়ানডেতে অভিষেক হলো মিরাজের। টেস্টের মতোই
স্মরণীয় অভিষেক। ব্যাটিংবান্ধব উইকেটে ১০ ওভার বোলিং করে ৪৩ রানে ২ উইকেট।
টার্ন আর বাউন্সে শ্রীলঙ্কান ব্যাটসম্যানদের চমকে দিয়েছেন। ফিল্ডিংয়ে
ছিলেন দারুণ সপ্রতিভ। তামিম বললেন, ‘ওকে দেখে মনেই হয়নি প্রথম ম্যাচ
খেলছে।’
আর জ্যেষ্ঠর প্রশংসায় ধন্য মিরাজ অকপটে স্বীকার করলেন,
স্নায়ুকাতরতায় ভুগছিলেন। কিন্তু ‘বড়দের’ আন্তরিক অনুপ্রেরণাতেই ভেতর থেকে
বেরিয়ে এসেছে স্বাভাবিক ক্রিকেট।
তামিম ও মিরাজের এই কথায় বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে মনে হয়
সুখী একটা গৃহকোণ। যেখানে বড় ভাইদের আন্তরিক তত্ত্বাবধানে সংসারের
দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে উদ্যোগী হয় ছোটরা।
বাংলাদেশের কাছে টেস্ট ও ওয়ানডেতে টানা হারের পর
শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট দল এমন গভীর বিষাদে ডুবে আছে যে, তাদের অধিনায়ক ও কোচ
সাংবাদিকদের মুখোমুখি হতে চাইছেন না। এখন সংবাদ সম্মেলনের মুখ হয়ে উঠেছেন
অশঙ্কা গুরুসিনহা। নানা কারণেই শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটের ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে
অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি দেওয়া বিশ্বকাপজয়ী দলের এই সদস্যকে ফিরিয়ে আনা
হয়েছে। আপাতত তাঁর পদ ক্রিকেট ম্যানেজার।
এই প্রথম তিনি শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটের কোনো পদে যুক্ত হলেন।
গুরুসিনহাও মনে করেন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের এখনকার সাফল্যের পেছনে অভিজ্ঞতা
ও তারুণ্যের অভূতপূর্ব মেলবন্ধনের অনেক অবদান, ‘ওদের (বাংলাদেশ) দলে বেশ
কয়েকজন অভিজ্ঞ ক্রিকেটার আছে। ওরা একসঙ্গে খেলছে ৮-৯ বছর ধরে। ওরা নিজেদের
অভিজ্ঞতা বিনিময় করছে তরুণদের সঙ্গে। দারুণ বোঝাপড়া ওদের মধ্যে।’
গুরুসিনহা, শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটে ‘গুরা’ নামেই যার সমধিক
পরিচিতি, নিজেদের সময়ের সোনালি দিনগুলোতেই যেন ফিরে গেলেন, ‘আমাদের সময়ও
এমনটিই হতো। অভিজ্ঞরা তরুণদের আপন করে নিত। একটা দল হিসেবে হারতে হারতেই
আমরা জয়ের রাস্তা খুঁজে পেয়েছি। তারপর সেটিকে পরিণত করেছি অভ্যাসে।
বাংলাদেশও এখন সেভাবে এগোচ্ছে।’
বাংলাদেশের কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে আগের দিন সপ্রশংস
বিস্ময়ে স্বীকার করলেন দলের জ্যেষ্ঠ ক্রিকেটারদের অবদান, ‘গল টেস্টে হারের
পর সিনিয়ররা যেভাবে সাড়া দিয়েছে, তাতে আমি মুগ্ধ। আর এতেই দলের শরীরী
ভাষা গেছে বদলে। এখন মনে হয় মাঠে সত্যিই ওরা নতুন কিছু দিতে চায়।’
জ্যেষ্ঠ ক্রিকেটাররা কীভাবে নতুন করে দায়িত্ববোধে
উদ্বুদ্ধ হলো সেটি আপনাদের অনেকটাই জানা। আগের বিকেলে উল্টোপাল্টা শট খেলে
ভয় ধরিয়ে দেওয়া সাকিব আল হাসান পি সারায় বাংলাদেশের শততম টেস্টে খেললেন
১১৬ রানের ইনিংস। দুই ইনিংস মিলিয়ে নিলেন ৬ উইকেট। তামিমের ব্যাট থেকে
দ্বিতীয় ইনিংসে বেরোল ম্যাচ জেতানো ঝকঝকে ৮২ রান। আর জ্যেষ্ঠদের
অনুপ্রেরণায় অভিষেকে প্রথম ইনিংসেই ৭৫ রানের কী অসাধারণ এক ইনিংস খেললেন
মোসাদ্দেক।
অভিজ্ঞ ও তরুণদের মিলিত অবদানে সেই থেকেই নতুন করে যেন
যাত্রা শুরু হলো বাংলাদেশের। আর সেটি দারুণ সাফল্যের ধারা বয়ে নিয়ে গেল
ডাম্বুলাতেও।
গুরুসিনহা অপেক্ষায় আছেন, উপুল থারাঙ্গা, দিনেশ চান্ডিমাল
ও থিসারা পেরেরার অভিজ্ঞতাও বাংলাদেশের মতো শ্রীলঙ্কার এক দিনের দলটিকে
ঋদ্ধ করবে। এবং এসএসসিতে এটাও হতে পারে তাদের অন্যতম সাফল্যসূত্র।
তবে মাশরাফিদের তাতে ভয়ের কিছু নেই। তাঁরা মনে করছেন
অভিজ্ঞতা ও তারুণ্যের মিলিত রসায়ন তাঁদের দলকে অনেকটা পথ এগিয়ে দিয়েছে
এরই মধ্যে। ওহ্, মাশরাফি-মুশফিক বা সাকিব-তামিমরা আবার সিনিয়র-জুনিয়র
বিভক্তিরেখায় বিশ্বাসী নন। সবাই দলের গর্বিত সদস্য!
No comments:
Post a Comment