Friday, March 24, 2017

এ যেন নীরব এক যুদ্ধ

স্টেডিয়ামের নাম রণগিরি ডাম্বুলা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম। ‘রণ’ মানে যুদ্ধ, সুতরাং রণগিরি নামটির সঙ্গে ‘যুদ্ধ, যুদ্ধ’ আবহটা যাচ্ছেও।
কলম্বোয় নিজেদের শততম টেস্টে জিতে দুই টেস্টের সিরিজ ড্র করেছে বাংলাদেশ। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট জয়ের স্বাদটা নতুন হলেও ওয়ানডে জয় দূরাগত কোনো শব্দ নয়। মোট ম্যাচ ৩৮টি হলেও চারবার তো হারানো গেছে ৫০ ওভারের ক্রিকেটের একদা ‘ক্ষত্রিয়দের’। সর্বশেষ জয়টি আবার আগের সিরিজেই, চার বছর আগের সিরিজে এই শ্রীলঙ্কার মাঠে। জয় জয়ের নেশা জাগায়, সুতরাং আজ ডাম্বুলায় শুরু তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজটা মাশরাফিদের জন্য ‘আরেক নতুন যুদ্ধ’ জয়ের অভিযান।
ওদিকে আবার বাংলাদেশের কাছে টেস্ট হেরে বিক্ষত অন্তরে প্রবলভাবে ঘুরে দাঁড়াতে চাইবে শ্রীলঙ্কা। কাল দুপুরের অনুশীলন শেষে সেই ইচ্ছেটা জানিয়েও গেলেন উপুল থারাঙ্গা।
মাশরাফিদের মন বলছে প্রথম ম্যাচ জেতা মানেই ওয়ানডে সিরিজ জয়ের দিকে এগিয়ে যাওয়া। মস্তিষ্কেরও ভিন্নমত হওয়ার কথা নয়। কারণ পরিসংখ্যান দুই দলের মধ্যে অভিজ্ঞতার যে ফারাক গড়ে দিয়েছে, তাতে বাংলাদেশ এগিয়ে থাকে অনেক। কুশল পেরেরা হ্যামস্ট্রিংয়ের চোটে প্রথম দুই ম্যাচের বাইরে চলে যাওয়ার পর শ্রীলঙ্কান স্কোয়াডের খেলোয়াড়দের মিলিত ওয়ানডের সংখ্যা ৬১৮। কুশল ওয়ানডে খেলেছেন ৬৮টি, তাঁর বদলি হিসেবে দলে আসা মিলিন্দা সিরিবর্ধনের ম্যাচসংখ্যা ১৪। আর বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের মিলিত ওয়ানডে সংখ্যা ১০৩১। মাশরাফি, সাকিব, মুশফিক, তামিম, মাহমুদউল্লাহ—এই পাঁচজনই খেলেছেন মোট ৭৯৬ ম্যাচ। কিন্তু পরিসংখ্যানকে মাঠের খেলায় নিরেট সংখ্যা হিসেবেই কি প্রতিপন্ন করে না ওয়ানডে ক্রিকেট? জয় দিয়ে শুরু করার আশাটা জানিয়েও মাশরাফি তাই হুংকার ছাড়েন না। বাংলাদেশের প্রেরণাদায়ী অধিনায়ক বাস্তবের জমিতেই পা রাখেন, ‘শেষ টেস্টে হারলেও ওয়ানডেতে ওরা বরাবরই ভালো দল। অভিজ্ঞতা সব সময় সত্যি হয় না।’ কাল সন্ধ্যায় এই লেখা যখন লিখছি ফ্লাডলাইটের আলোয় সেন্টার উইকেটের নেটে ব্যাটিং তাণ্ডব চালাচ্ছিলেন তামিম-সাকিব। সানজামুল-মিরাজদের উড়িয়ে উড়িয়ে চার-ছক্কা মারছিলেন। মানেটা কী? মনের মধ্যে আগুনটাকে জ্বালিয়ে রাখা।
আগুন জ্বালাতেই হবে। তিন ম্যাচ সিরিজের ডাম্বুলা পর্বের প্রথম দুটি ম্যাচ জয়ের তাড়না তো আছেই, আরও কতগুলো বিষয়ও এসে পড়ছে একই সঙ্গে। র্যাঙ্কিং আছে, আসন্ন চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে নিজেদের যোগ্য বলে তুলে ধরার প্রেরণা আছে। আগামী ২০১৯ বিশ্বকাপে সরাসরি খেলতে চাইলে সাত নম্বর র্যাঙ্কিংটা ধরে রাখতে হবে। সিরিজ জয় সে কারণেই কাঙ্ক্ষিত। অতিকাঙ্ক্ষিত অন্তত একটি ম্যাচ জয়। তা ছাড়া এই মাঠে আগের তিনটি ম্যাচে বিশাল ব্যবধানে হারের ক্ষতে একটু প্রলেপও তো বোলানো দরকার। ডাম্বুলায় দুটি মাত্র তিন শ ছাড়ানো ইনিংসই হয়েছে বাংলাদেশের বিপক্ষে। ২০১০ এশিয়া কাপে শ্রীলঙ্কা প্রথম তিন শ রান করে জেতার পর, মাঠের সর্বোচ্চ ৩৮৫ রান করল পাকিস্তান। উহ্, শহীদ আফ্রিদির সেই তাণ্ডব (৬০ বলে ১২৪) এখনো যেন কান্না হয়ে ঝরে মাশরাফি, মুশফিক, সাকিব, তামিমদের কাছে।
র্যাঙ্কিং-বিষয়ক প্রশ্নে মাশরাফি দিলেন ‘স্লোয়ার’, ‘র্যাঙ্কিংটা একেবারেই মাথায় আনতে চাই না। তাহলে চাপে পড়ে যাব।’ অর্থাৎ, একেকটা করে ম্যাচ তো আগে খেলি, জয়টাই গুরুত্বপূর্ণ।
তাহলে যা দাঁড়াচ্ছে, মাশরাফিরা সব হিসাব মাথায় রেখেই নীরব হয়ে আছেন ‘যুদ্ধ’ জয়ের আকাঙ্ক্ষায়। যুদ্ধ জিততে গেলে সৈন্যসামন্ত, গোলাবারুদ সব পরখ করে নেওয়া লাগে। একাদশ কেমন হবে, তা জানা যায়নি। মাশরাফি বললেন, কাল (আজ) ঠিক হবে। কলম্বো-ঢাকা-খুলনা-ঢাকা-কলম্বো-ডাম্বুলা—আকাশময় উড়ে উড়ে দলের ডাকে হন্তদন্ত হয়ে শ্রীলঙ্কায় ফিরতে হয়েছে মিরাজকে। তাঁর কি অভিষেক হচ্ছে ওয়ানডেতে? অধিনায়কের জবাব স্পষ্ট নয়। হতে পারে, না-ও পারে। তবে ডাম্বুলার উইকেটের যে চরিত্র, তাতে তিন পেসার ও দুই বিশেষজ্ঞ স্পিনার নিয়েই হয়তো নামবে বাংলাদেশ। এটা তো আপনাদের জানাই যে সাকিব বিশেজ্ঞ স্পিনারের দলে পড়েন না!
কৌতূহল আছে উইকেট নিয়েও। সেই চিরচেনা ডাম্বুলা নিশ্চয়ই চরিত্র বদলাবে না। পাশে বিশাল হ্রদ থাকায় এখানে পানির স্তর খুব উঁচুতে। প্রথম দিকের আর্দ্র উইকেট সময় গড়াতে গড়াতেই নিচু ও মন্থর হয়ে পড়ে।
গলে তেমন দেখা যায়নি, কলম্বোতেও নয়। কিন্তু ডাম্বুলাবাসীর মধ্যে ক্রিকেট নিয়ে অনেক আগ্রহ। স্টেডিয়ামঘেরা বেড়ার পাশে দোকান পসরা বসছে। টিকিট কাটছেন অনেকেই। শ্রীলঙ্কানরা শেষ টেস্টে হারের ‘দুঃখ’ ঘোচাতে চায় ওয়ানডে জিতে।
স্টেডিয়ামের তিন দিক খোলা—পশ্চিম দিকে হ্রদ, বাকি দুই দিকে পাহাড় আর অরণ্য। বাংলাদেশ সময় বিকেল তিনটায় শুরু ম্যাচ যখন শেষ হবে, নিশ্চিতই একটা আরণ্যক নিশুতি নামবে এখানে। সেই নিশুতির মধ্যে জয়ের পতাকা উড়বে কোন দলের? মাশরাফির বাংলাদেশের, নাকি থারাঙ্গার শ্রীলঙ্কার?

No comments:

Post a Comment

Sponsor