কেউ তাঁকে ডাকছেন উপুল, কেউ চন্ডিকা, কেউবা শেষ নামটিকে সংক্ষিপ্ত করে
হাথু। আর তিনি উপুল চন্ডিকা হাথুরুসিংহে একবার সাথি কুমারাস্বামী
প্যাভিলিয়নের দিকে যাচ্ছেন, সেখান থেকে ফিরছেন মহাদেবন সত্যশিবম
প্যাভিলিয়নের দিকে। কখনো তাকাচ্ছেন মাঠের পাশের তালগাছগুলোর দিকে, কখনো চোখ
উঁচু মাটির ঢিবির গ্যালারিতে।
তামিল ইউনিয়ন ক্রিকেট ও অ্যাথলেটিক
ক্লাবের মাঠ পি সারা ওভাল যে হাথুরুসিংহের হৃদয়ের খুব কাছাকাছি। এখানেই
তাঁর ক্রিকেট ক্যারিয়ার পাপড়ি মেলেছিল। ২০ বছর বয়সে ১৯৮৮-৮৯ মৌসুমে তামিল
ইউনিয়ন ক্লাবের হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক। ১৭ বছর পর এখানেই শেষ
করেছেন খেলোয়াড়ি ক্যারিয়ার। এর মাঝে শ্রীলঙ্কার হয়ে খেলেছেন ২৬টি টেস্ট ও
৩৫টি ওয়ানডে।
বাংলাদেশের শততম টেস্ট শুরুর দুই দিন আগের এক সকালে
স্মৃতিকাতর এক হাথুরুসিংহেকেই পাওয়া গেল পি সারায়। মুখ ফুটে কিছু বলেননি।
তা সবকিছু কি আর মুখে বলতে হয়! তাঁকে দেখেই তো মনে হলো ঘাসে পা রেখে
খুঁজছেন এই মাঠে প্রথম পা ফেলার স্মৃতিচিহ্ন। প্যাভিলিয়নের দিকে এমনভাবে
তাকাচ্ছেন, যেন ওখানে প্রথম এসে দাঁড়ানোর হারিয়ে যাওয়া ছবিটা আঁকছেন।
খেলোয়াড়
হিসেবে বিরাট কিছু ছিলেন না। ডানহাতি ওপেনিং ব্যাটসম্যান, মিডিয়াম পেস
বোলিংটাও খারাপ করতেন না। কিন্তু খেলোয়াড় হিসেবে নয়, জীবনের সবচেয়ে বড়
অর্জনটা কোচ হিসেবে পেলেন এই পি সারাতেই। বাংলাদেশ নিজেদের শততম টেস্টে
হারিয়ে দিল শ্রীলঙ্কাকে! হাথুরুসিংহের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে মনে হলো, গলার
স্বরটা একটু একটু কাঁপছে!
মাঠের এক পাশে ম্যাচের পুরস্কার বিতরণী চলছে।
এক মধ্যবয়সী শ্রীলঙ্কান ক্লাবের বার থেকে অতিরিক্ত পানের কল্যাণে চিৎকার
করছেন (অবশ্যই ইংরেজিতে), ‘বাংলাদেশ, তোমায় অভিনন্দন। শ্রীলঙ্কা, তুমি শেষ!
এই জয় মুশফিকের জন্য। এই জয় সাকিব ও তামিমের জন্য। এই জয় হাথুরু ও থিলানের
(সামারাবীরা) জন্য।’
শুধু ওই লোকটিই নন, এখন পুরো শ্রীলঙ্কাই বিশ্বাস
করে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক টেস্ট জয়ের মূল কারণ শ্রীলঙ্কান কোচিং স্টাফ।
প্রধান কোচ হাথুরুসিংহে তো আছেনই, তাঁর দুই সহকারী থিলান সামারাবীরা
(ব্যাটিং পরামর্শক) ও মারিও ভিল্লাভারায়ণও (ট্রেনার) এই জয়ের চিত্রনাট্যটা
তৈরি করেছেন।
পরের দিন বেশ কয়েকটি শ্রীলঙ্কান দৈনিকে হাথুরু সম্পর্কে
সপ্রংশস কথা। একটি পত্রিকা লিখল, যে হাথুরুসিংহেকে শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট বোর্ড
২০১০ সালে একরকম দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিল, সেই হাথুরুই আসলে এই জয়ের
রূপকার।
দুই দিন পর শ্রীলঙ্কার বেশ কয়েকজন সাবেক ক্রিকেটার
হাথুরুসিংহেকে অভিনন্দন জানাতে ছুটে এলেন কলম্বো ক্রিকেট ক্লাব গ্রাউন্ডে।
সেদিন ছিল শ্রীলঙ্কান বোর্ড সভাপতি একাদশের বিপক্ষে বাংলাদেশের প্রস্তুতি
ম্যাচ। এঁদের মধ্যে অগ্রণী রোশান মহানামা। বন্ধুকে বুকে জড়িয়ে ধরে তো আর
ছাড়েনই না। বন্ধু, কী খবর বল! সামারাবীরা ও ভিল্লাভারায়ণও সিক্ত হলেন অনেক
বন্ধুর শুভেচ্ছায়।
দিলীপ সামারাবীরার ছোট ভাই থিলান সামারাবীরার
ক্রিকেট ক্যারিয়ার আরও উজ্জ্বল। পাকিস্তান সফরে গিয়ে সন্ত্রাসীর বুলেটে
বিদ্ধ হয়েও আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ছাড়েননি। ৮১টি টেস্ট খেলেছেন, ১৪টি
সেঞ্চুরি, প্রায় ৪৯ গড়ে ৫৪৬২ রান। প্রতিটি রানই যেন সাহস ও ধৈর্যের গল্প।
ভিল্লাভারায়ণের প্রথম শ্রেণির ক্যারিয়ারও দারুণ উজ্জ্বল, ব্লুমফিল্ডে ছিলেন
দোর্দণ্ড প্রতাপ এক মিডিয়াম ফাস্ট বোলার, ১২ বছরের ক্যারিয়ারে ৩৭৮ উইকেট,
এক ইনিংসে ৯ উইকেটও নিয়েছেন। দুর্ভাগ্য যে, টেস্টের দুয়ার দিয়ে ঢুকব ঢুকব
করেও আর ঢোকা হয়নি।
টেস্টের পর ডাম্বুলায় প্রথম ওয়ানডেতে বিধ্বংসী জয়।
শ্রীলঙ্কান ক্রিকেট সাংবাদিকদের বিশ্বাস, শ্রীলঙ্কান কোচিং স্টাফের কারণেই
বাংলাদেশ বদলে গেছে। আমজনতার মুখেও একই কথা। শ্রীলঙ্কায় তাহলে শ্রীলঙ্কা
বনাম ‘শ্রীলঙ্কা’ লড়াই চলছে নাকি? এক ড্রেসিংরুমে শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটারের
দল, অন্য ড্রেসিংরুমে শ্রীলঙ্কান কোচিং স্টাফ!
শ্রীলঙ্কায় নিচু স্বরে হলেও একটা রব উঠে গেছে, দক্ষিণ আফ্রিকান কোচিং স্টাফ বাদ দিয়ে ফিরিয়ে আনো হাথুরুকে।
কাল
বিব্রতকর এ প্রশ্নটির সামনে পড়তে হলো হাথুরুকে। সুযোগ পেলে শ্রীলঙ্কায়
ফিরে আসবেন নাকি? বাংলাদেশের শ্রীলঙ্কান কোচ কৌতুকপ্রবণ, ‘আপনারা কি
বিসিবির কাছে আমাকে বরখাস্ত করার সুপারিশ করবেন?’
পরের বাক্যেই বেরিয়ে
এল হাথুরুসিংহের আদ্যন্ত পেশাদার রূপটা, ‘বাংলাদেশের কাছে শ্রীলঙ্কা হারছে,
আমি খুব খুশি। কারণ তার মানে আমি আমার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছি।’
No comments:
Post a Comment