Thursday, March 16, 2017

মোবাইল ফোন কখন বিপদ ডেকে আনে

গদ্যকার্টুনে আমার চেষ্টা থাকে হাস্যরসাত্মক বিষয় নিয়ে লেখার। এই কলামে কৌতুক পরিবেশন করি, কখনো হয়তো করে থাকি বিদ্রূপ। কিন্তু আজকে কতগুলো গুরুতর পরামর্শ দেব।
প্রথমেই জানিয়ে দেব ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক সামন্তলাল সেনের পরামর্শ। তিনি আমাকে একদিন ফোন করে বলেছেন, দয়া করে মোবাইল ফোন চার্জ দিতে দিতে ফোনে কথা বলবেন না বা ফোনে কথা বলতে বলতে মোবাইল ফোনের ব্যাটারিতে চার্জ দেবেন না। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের বার্ন ইউনিটে প্রচুর রোগী আসেন, মারাত্মকভাবে আহত হয়ে, কান, চোখ, মাথায় পোড়া ক্ষত নিয়ে, যাঁরা ফোনে কথা বলছিলেন আর ব্যাটারি চার্জ হচ্ছিল, মোবাইল ফোন বিস্ফোরিত হয়ে তাঁরা মারাত্মক আহত হয়েছেন।’

আমি এই কলামের মাধ্যমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের প্রধানের সতর্কবাণী আপনাদের জানিয়ে দিলাম। আশা করি, তাঁর পরামর্শ আপনারা মেনে চলবেন। দুর্ঘটনা এড়িয়ে চলবেন। ফোনে চার্জ হচ্ছে, এ অবস্থায় কল এল, চার্জারের সংযোগটা খুলে ফেলুন, তারপর কথা বলুন।
প্রসঙ্গটা এল গত পরশু (১৫ মার্চ ২০১৭) প্রথম আলোর অনলাইনে প্রকাশিত একটা খবর আর তার ছবি দেখে। শিরোনাম: হেডফোনে বিস্ফোরণ। উড়োজাহাজে করে বেইজিং থেকে মেলবোর্ন যাচ্ছিলেন এক তরুণী। প্লেনের হেডফোন কানে ছিল। সেটা বিস্ফোরিত হয়। আগুন জ্বলে ওঠে, প্লাস্টিক পোড়া গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। বিমানের ক্রুরা এসে আগুন নেভান। কিন্তু তরুণীর মাথা, মুখমণ্ডল, কান, হাত দগ্ধ হয়। এর আগেও বিমানে হেডফোন বিস্ফোরিত হয়েছে। আর মোবাইল ফোনের ব্যাটারি বিস্ফোরিত হওয়ার খবর এর আগেও আমরা পেয়েছি।
হেডফোন ব্যবহার করবেন না, এই আবেদন আমি করতে পারছি না। কিন্তু এ কথা আমি আপনাদের নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, রাস্তা পেরোনোর সময় কানে হেডফোন রাখবেন না। গান শুনতে শুনতে রাস্তা পেরোনো উচিত নয়। আমার নিজের মত হলো, কানে হেডফোন লাগিয়ে গাড়ি চালানোও উচিত নয়।
মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে রাস্তা পার হওয়া রীতিমতো আত্মঘাতী কাজ।
প্রিয় পাঠক, সাবধান। এক. মোবাইল ফোন চার্জ দিতে দিতে ফোনে কথা বলবেন না। দুই. মোবাইল ফোন বা হেডফোন কানে দিয়ে রাস্তা পেরোবেন না
সরোজিনী সাহু নামে ওডিশার একজন বিখ্যাত লেখিকা আছেন। তিনি অনলাইনে আমার মা বইটি পড়ে সপ্রশংস মন্তব্য করেছিলেন, পরবর্তীকালে ভুবনেশ্বর থেকে মা বইটি ওড়িয়া ভাষায় অনূদিত হয়ে প্রকাশিত হয়েছিল, তার পেছনে ছিলেন আমার এই দিদি। সরোজিনী সাহু ঢাকায় এসেছিলেন, ঢাকা থেকে তাঁর উপন্যাস অনূদিত হয়ে বেরিয়েছিল, মিথ্যা গেরস্থালি। তাঁর স্বামী জগদীশ মোহান্তি খুবই সজ্জন ছিলেন। আমরা ভুবনেশ্বরে একসঙ্গে অনেক উজ্জ্বল প্রহর কাটিয়েছিলাম। একদিন শুনলাম, জগদীশ দা আর নেই। তিনি রেললাইন পার হতে গিয়ে ট্রেনের ধাক্কায় মারা গেছেন। হয়তো তাঁর কানে ছিল একটা মোবাইল ফোন। মোবাইল ফোনে কথা বলতে গিয়ে তিনি ট্রেনের আগমন টের পাননি।
বাংলাদেশে মোবাইল ফোনে কথা বলতে গিয়ে ট্রেনে কাটা পড়ে মানুষ মারা যাওয়ার অনেক ঘটনা ঘটেছে। ২০১৬ সালের ২০ মে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ওবায়দুল্লাহ (২৫) কমলাপুরগামী ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে মারা যান, তাঁর এক হাতে ছিল আইসক্রিম আর কানে ছিল মোবাইল ফোন। ঘটনা ঘটে তেজগাঁওয়ের নাখালপাড়ায়, বহু মানুষের সামনে। ওবায়দুল্লাহ অর্থনীতি বিভাগের দ্বিতীয় সেমিস্টারে পড়তেন। গত বছর ২০ ফেব্রুয়ারি মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে রেললাইন পেরোতে গিয়ে মালিবাগে মারা যান হেমায়েত হোসেন (১৮)।
মোবাইল ফোনে গাড়ির চালক কথা বলতে গিয়ে বড় দুর্ঘটনা ঘটিয়েছেন, তার উদাহরণ সারা পৃথিবীতে অসংখ্য আছে। গত বছর ১৪ জুলাই মাদারীপুরে এক বাসের চালক মোবাইল ফোনে কথা বলতে গিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েন। গাড়ি একটা গাছের সঙ্গে ধাক্কা লাগে। ছয়জন নিহত হয়।
মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে এবং কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনতে শুনতে রেললাইন পার হতে গিয়ে প্রাণহানির ঘটনায় উদ্বিগ্ন হয়ে গত বছর অক্টোবর মাসে একটা জনসচেতনতা প্রচারণা কর্মসূচি সূচনা করার ঘোষণা দিয়েছিলেন টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম। রেল বিভাগ থেকে প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে রেললাইন না পেরোনোর জন্য আহ্বানও জানানো হয়েছিল।
শুধু যে রেললাইন পার হতে গিয়ে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীরা দুর্ঘটনার শিকার হন, তা নয়, সড়ক পেরোতে গিয়েও তাঁরা দুর্ঘটনার শিকার হন বা দুর্ঘটনার কারণ হন। আনন্দবাজার পত্রিকা জানাচ্ছে, ২০১৫ সালে বর্ধমানের ফাগুপুরে এক ব্যক্তি মোবাইল ফোন
কানে দিয়ে রাস্তা পেরোনোর সময় গাড়ির নিচে পড়েন। এরপর আরও দুটো গাড়ি তাঁকে ধাক্কা দিয়ে চলে যায়। ঘটনাস্থলেই এই হতভাগ্য ব্যক্তির মৃত্যু ঘটে। যুক্তরাজ্যে মোটরগাড়ি দুর্ঘটনার সবচেয়ে বড় কারণ বলা হয়েছে মোবাইল ফোনকে। এর মধ্যে গাড়ি চালাতে চালাতে মোবাইল ফোনে টেক্সট বার্তা পাঠানো অন্যতম কারণ। সম্প্রতি গাড়ি চালানো অবস্থায় মোবাইল ফোন ব্যবহার নিষিদ্ধ করে কঠোর শাস্তির বিধান করা হয়েছে। এমনকি এর জন্য লাইসেন্স কেড়ে নেওয়ার সাজাও রয়েছে।
আমি একবার ঢাকা-বগুড়া মহাসড়কে এক মোটরসাইকেলচালককে দেখেছিলাম, তিনি ওই ব্যস্ত হাইওয়েতে মোটরবাইক চালাতে চালাতে মোবাইল ফোনে টেক্সট করছিলেন। তাঁর মোটরসাইকেল সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলছিল। হে মাবুদ, আমাদের রক্ষা করো।
আমি মাঝেমধ্যে ঢাকার রাস্তায় পথচারীদের দিকে লক্ষ করি। কতজনের কানে মোবাইল ফোন। বেশির ভাগই ফোনে কথা বলতে বলতে চলছেন। চলুন। ক্ষতি নেই। কিন্তু মোবাইল ফোন কানে দিয়ে রাস্তা পারাপার করার চেষ্টা করা আত্মহত্যার চেষ্টা করারই শামিল।
ঢাকার রাস্তায় এত যানজট যে চালকেরা গতি বাড়াতে পারেন না, এই ধরনের পথচারীকে দেখে সাধারণত থেমে যান। কিন্তু রাস্তা একটু ফাঁকা হলে বাঁচার কোনো সম্ভাবনাই নেই। একটা গবেষণায় বলা হয়েছে, মাল্টি টাস্কার বলে কিছু নেই, একই সঙ্গে কোনো মানুষ দুটো কাজে মনোযোগ দিতে পারেন না, আপনি মোবাইলে কথা বলবেন, আবার রাস্তা পার হওয়ার জন্য এদিক-ওদিক ঠিকভাবে তাকিয়ে দেখবেন, দুটো কাজ করা সম্ভব নয়।
এখানে চাঁদপুরের সেই সত্য ঘটনাটা আমি বলব। একজন পাগল চাঁদপুরের রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে ট্রাফিক কন্ট্রোল করতেন। সাইডে, সাইডে। রিকশা, সাইকেল, গাড়ি দুপাশে সরে যেত। একবার তিনি চলে গেলেন রেলপথে। রেললাইনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে তিনি উপদেশ দিতে লাগলেন, সাইডে, সাইডে। ট্রেন আর তাঁকে সাইড দিল না।
আমরা কানে মোবাইল ফোন বা হেডফোন লাগিয়ে রাস্তা পার হই, চালক নিজ দায়িত্বে আমাদের বাঁচিয়ে চলেন, কিন্তু রোজ চলবেন না। দ্রুতগামী গাড়ি থামতে পারবে না, থামলেও পেছন থেকে আরেকটা এসে তাকে মেরে দেবে। আর ট্রেন? সে তো থামবেই না।
কাজেই, প্রিয় পাঠক, সাবধান। এক. মোবাইল ফোন চার্জ দিতে দিতে ফোনে কথা বলবেন না। দুই. মোবাইল ফোন বা হেডফোন কানে দিয়ে রাস্তা পেরোবেন না।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

No comments:

Post a Comment

Sponsor