একটু দূরের পাহাড়গুলোতে, একটু কাছের হ্রদের পাড়ে আর খুব কাছের
গাছগাছালির ঘন অন্ধকারে রাতের নিশুতি নেমেছে। বাড়ি ফিরে যেতে থাকা
শ্রীলঙ্কান কোনো সমর্থকের বাঁশি, কিংবা ঢোল যে শব্দ তুলছে, তা আসলে নীরব
হাহাকার। কিংবা বলতে পারেন বাংলাদেশের জয়কে ব্যথাতুর বুকে স্বাগত জানানো।
নিজেদের শততম টেস্টে কলম্বো জয়ের পর বাংলাদেশ তিন ম্যাচের ওয়ানডে
সিরিজ শুরু করল কাল ডাম্বুলা জয় করে। ২০০১ সালে যাত্রা শুরু করে রণগিরি
ডাম্বুলা স্টেডিয়াম তার আগের ৪৮ ম্যাচের জীবনে কখনো তিন শ পেরোনো জয়
দেখেনি। তামিমের অষ্টম ওয়ানডে সেঞ্চুরি, সাকিবের ৭১ বলে ৭২ আর সাব্বিরের
৫৬ বলে ৫৪ রান বাংলাদেশকে তুলে দিয়েছিল ৩২৪ রানের পাহাড়চূড়ায়। এই মাঠের
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আর বাংলাদেশের তৃতীয় সর্বোচ্চ দলীয় রানের দিকে ছুটতে
গিয়ে শ্রীলঙ্কা থেমে গেল ২৩৪ রানে। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বাংলাদেশ পেল পঞ্চম
ওয়ানডে জয়, সব মিলিয়ে যা ১০২তম আর ২০১৭ সালে প্রথম। এ বছর অবশ্য
বাংলাদেশের এটাই প্রথম ওয়ানডে।
স্বাধীনতা দিবসের আগের রাতে বলে জয়টিকে মনে
হচ্ছে আরও মধুর। শ্রীলঙ্কান সাংবাদিকেরা জয়ের পর ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি তুলে
স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা জানিয়ে গেলেন বাংলাদেশের বিশাল সাংবাদিক বহরকে।
এই
জয়ের পথে বাংলাদেশ বোলিংয়ে শ্রীলঙ্কাকে প্রথম ধাক্কাটা দেয় প্রথম
ওভারেই। যখন অধিনায়ক মাশরাফি তাঁর তৃতীয় বলেই এলবিডব্লু করেন ওপেনার
দানুষ্কা গুনাতিলকাকে। এরপর দৃশ্যপটে উপস্থিত অভিষিক্ত মেহেদী হাসান মিরাজ ও
তাসকিন আহমেদ। একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে মিরাজের প্রথম শিকার গল টেস্টের
নায়ক কুশল মেন্ডিস। অধিনায়ক উপুল থারাঙ্গাকে গতির তোড়ে তুলে নেন
তাসকিন। ১১ ওভারেই ৩ উইকেট হারিয়ে শ্রীলঙ্কা তখন ৩১। ওভারপিছু ৬.৫০ রান
তোলার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে এই সময়ে ৩ রান করেই তুলতে পারেনি শ্রীলঙ্কা। ১৫
ওভার শেষে তারা ৩ উইকেটে ৪৩। অথচ ১৫ ওভারে ১ উইকেটে বাংলাদেশের রান ছিল
৮৯। থারাঙ্গার দল ম্যাচের এক-তৃতীয়াংশ না যেতেই যেভাবে পিছিয়ে পড়ে,
সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানোটা ছিল কঠিন। দিনেশ চান্ডিমাল ও আসেলা গুনারত্নে
চতুর্থ উইকেটে ৫৬ রানের জুটি গড়ে একটু আশা জাগিয়েছিলেন, আসলে যা দূরতর
আশা। চান্ডিমালকে চাতুর্যের সঙ্গে ফিরিয়েছেন ওই মিরাজ, তবে বিদায়ের আগে
সর্বোচ্চ ৫৯ রান করে গেছেন তিনি। ৩৫ বলে শ্রীলঙ্কার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৫৫
রান করেছেন আটে নামা থিসারা পেরেরা। মাঝে মাঝেই কমে আসা আলোর মধ্যে হয়তো
নিবু নিবু আশার মতো ব্যাট করেছেন এই বাঁহাতি, তবে শেষ পর্যন্ত চাপমুক্ত
হয়ে একটু বিনোদনদায়ী ছাড়া আর কিছু হতে পারেননি। আরেকটা কাজও তিনি
করেছেন, ম্যাচটিকে বিলম্বিত করে বাংলাদেশকে ১০০ রানের ব্যবধানে জিততে
দেননি।
টস করার মুদ্রাটা হাতে নিয়ে ফেলে দিয়েছিলেন উপুল থারাঙ্গা। এর
মধ্যে ক্রিকেটীয় কোনো কারণ নেই। নিতান্তই ঘটনাচক্র। কিন্তু এর মধ্যে আপনি
একটা ক্রিকেটীয় সংস্কার খুঁজে পেতে পারেন। তবে শ্রীলঙ্কান অধিনায়ক টস
জেতার পর থেকে বেশিটা জুড়েই ম্যাচ তাঁর দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসল।
ম্যাচ
অবশ্য তাদের দিকেই মধুর দৃষ্টিতে তাকায়, যারা তাকে অন্তর দিয়ে পেতে
চায়। সেই চেষ্টাটা শুরু থেকেই ছিল মাশরাফির দলের মধ্যে। একটু দেরিতে সুইং
করে বেরিয়ে যাওয়া সুরঙ্গা লাকমলের বলে ক্যাচ দিয়ে ফিরেছিলেন সৌম্য
সরকার। এরপর বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরাই শাসন করেছেন শ্রীলঙ্কার বোলিং।
বোলিংয়ে প্রথম ওভারেই যদি বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কাকে ধাক্কা দেয়, তাহলে তাদের
কোণঠাসা করে ফেলার কাজটা করেছে ব্যাটিংয়ে। নিজের অষ্টম আর শ্রীলঙ্কার
বিপক্ষে দ্বিতীয় সেঞ্চুরিটি পাওয়ার পথে তামিম দ্বিতীয় উইকেটে ৯০ রানের
জুটি গড়েছেন সাব্বিরের সঙ্গে। সাকিবের সঙ্গে ওয়ানডেতে প্রথমবারের মতো
শতরানের জুটিটিকে ২৩.৪ ওভারে নিয়ে গেছেন ১৪৪ রানে।
গোড়ায় একটু
সংগ্রাম করতে হয়েছে, তারপর ইচ্ছেমতো জুটি গড়েছেন তামিম, সাব্বির,
সাকিবেরা। আর তাতেই ৩২৪ রানের চূড়ায় বসা। এর চেয়ে বেশি রান করেও একবার
হারের যন্ত্রণায় পুড়তে হয়েছে। ২০১৪ এশিয়া কাপে ঢাকার এক নির্মম রাতে
৩২৬ পেরিয়েও জিতে গিয়েছিল শহীদ আফ্রিদির পাকিস্তান। কিন্তু ডাম্বুলায়
৩০০ রান তাড়া করে জয়ের ইতিহাস নেই। সর্বোচ্চ ২৮৯ রান তাড়া করে জিতেছে এই
শ্রীলঙ্কাই, পাকিস্তানের বিপক্ষে।
ম্যাচের আগে মাশরাফি একটু ভয়
পাচ্ছিলেন শ্রীলঙ্কার তিন ফাস্ট বোলারকে। বিশেষ করে ২০ বছর বয়সী লাহিরু
কুমারাকে। শেষ পর্যন্ত কোনো বোলারই পাত্তা পায়নি তামিম-সাকিব-সাব্বিরদের
কাছে। ১৪৫ কিলোমিটার গতির কুমারা ৮ ওভারে ৭৪ রান দিয়ে পেয়েছেন মাত্র একটি
উইকেট। সফলতম বোলার সুরঙ্গা লাকমল, ৮ ওভারে ৪৫ রান দিয়ে নিয়েছেন ২ উইকেট।
শুধু
সৌম্য ও মুশফিকের রান না পাওয়া ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাটিংয়ে দেখিয়েছে
দুর্দান্ত ব্যাটিং প্রদর্শনী। বোলিং-ফিল্ডিংও হয়েছে দারুণ। এ যেন এক নতুন
বাংলাদেশ, যারা দেশের পরিধি ছাড়িয়ে এখন জয়ের সুবাস ছড়িয়ে দিতে চায়
দেশান্তরে।
তিন ম্যাচের সিরিজের প্রথমটি জিতে বাংলাদেশ এগিয়ে গেল ১-০
ব্যবধানে। আগামী পরশু দ্বিতীয় ওয়ানডেতে এখানেই হতে পারে সিরিজ জয়ের
উৎসব।
ম্যাচ শেষে ম্যাচের সেরা তামিম জানিয়ে গেলেন, এই অবস্থায় অবশ্যই
সিরিজ জয় সম্ভব। শততম টেস্ট জয়ের পর জয় দিয়ে ওয়ানডে সিরিজ শুরু।
রাতের ডাম্বুলাও যেন বাংলাদেশের জয়ের সম্ভাবনার কথাই বলে যাচ্ছে নীরবে।
বাংলাদেশ: ৫০ ওভারে ৩২৪/৫
শ্রীলঙ্কা: ৪৫.১ ওভারে ২৩৪
ফল: বাংলাদেশ ৯০ রানে জয়ী
No comments:
Post a Comment