Thursday, March 9, 2017

বাতিঘরের সন্ধানে



বাংলাদেশ দল গলে যে হোটেলে উঠেছে, সেটির নাম লাইট হাউস, সোজা বাংলায় বাতিঘর একেবারেই সমুদ্রের কোলে বারান্দায় এসে দাঁড়ালে মনে হবে ঢেউগুলো এই বুঝি হাত ধরে ফেলবে গল টেস্টের তৃতীয় দিন শেষে পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে, তাতে অন্ধকারে পড়ে গোটা বাংলাদেশ দলকেই এখন হাত ধরাধরি করে বাতিঘরের সন্ধান করতে হচ্ছে
পরিস্থিতি কেমন, সেটি একটু বুঝিয়ে বলা যাক। শ্রীলঙ্কার ৪৯৪ রানের জবাবে বাংলাদেশের প্রথম ইনিংস শেষ হয়ে গেছে ৩১২ রানে। কাল তৃতীয় দিনের শেষ সেশনটি মেঘ-বৃষ্টির পেটে না গেলে ১৮২ রানের সঙ্গে আরও রানের বোঝা চাপত পিঠে। সেই বোঝা চতুর্থ দিনে আরও বেড়ে বেড়ে হয়ে দাঁড়াত দুর্বহ। বৃষ্টি আর আলোকস্বল্পতা বন্ধুর মতোই একটু কাজ করেছে মুশফিকদের জন্য।
তাতেও স্বস্তি কোথায়? সামনে পড়ে আছে দুটি দিন। বাংলাদেশের জয়ের স্বপ্নটা সুদূরে মিলিয়ে গেছে, ‘এখনো সুযোগ আছেকথাটা বলারও সুযোগ নেই। আকুলি-বিকুলি করছে শুধুই ম্যাচ বাঁচানোর চিন্তা।
ম্যাচ বাঁচাতে পারলেও একধরনের জয়ের স্বাদই পাওয়া হবে। এখানে মাত্রই আগের টেস্টের সেই গৌরবময় ড্রটাকে স্মৃতিতে তুলে আনলে এবার হারের কথাটা ভাবতেও কষ্ট হয়। গতবারের চেয়েও খর্বশক্তির আর কম অভিজ্ঞ তরুণ শ্রীলঙ্কার কাছে হারলে সে বড় মর্মান্তিক হয়ে বাজবে মুশফিকদের বুকে।
পিচে কোনো জুজু নেই। এখানে পরম শান্তিতে ব্যাট করা যায়। বাংলাদেশের কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে লক্ষ্য বেঁধেছিলেন ৬০০ রানের। সেটি না হলেও শ্রীলঙ্কানদের খুব কাছাকাছি যাওয়ারই সাধ ছিল। কিন্তু কেন হলো না? সাধ থাকলেও সাধ্যে অনেক সময় কুলোয় না। যাঁরা সাধ আর সাধ্যের সমন্বয় ঘটাবেন, সেই ব্যাটসম্যানরাই যে পারলেন না। ৩৬১ রানে পিছিয়ে থেকে দিন শুরু করা দলের যেভাবে ব্যাট করতে হয়, হলো তার উল্টোটা। প্রয়োগক্ষমতা দেখাতে পারলেন না সৌম্য-সাকিব-মাহমুদউল্লাহরা। অপরাজিত ৬৬ রানে শুরু করা ওপেনার সৌম্য প্রথম পেস বোলিংয়ের মুখোমুখি হতেই আউট, যোগ করতে পারলেন আর রান। সাকিব ওয়ানডের আদলে ব্যাটিং করে বিদায় ২৩ রানে। আগের টেস্টেই বহুপ্রতীক্ষিত একটি ফিফটি করা মাহমুদউল্লাহও ফেরেন দ্রুতই। লিটন দাসও ভিন্ন পথের যাত্রী নন। সকালের সেশনে ৫০ রানের মধ্যে এই চার বিশেষজ্ঞ ব্যাটসম্যানকে হারিয়ে বাংলাদেশ ফলোঅনের লজ্জাই পেত যদি না, মুশফিক মিরাজ ঘুরে দাঁড়াতেন। তাঁরা দুজন সপ্তম উইকেটে গড়েছেন ১০৬ রানের জুটি। ৯০তম ওভারে ফলোঅন এড়ানোর পর প্রতিশ্রুতিমতো এগোতে পারেনি ইনিংস। ডিআরএস নিয়ে ২৯ রানে বেঁচে যাওয়া মিরাজকে এলবিডব্লু করেছেন অফ স্পিনার দিলরুয়ান পেরেরা, পরের বলেই তাসকিনকে এলবিডব্লু করে হ্যাটট্রিকের আশাই জাগিয়েছিলেন। সেটি হতে দেননি শুভাশিস। ১৪ বল খেলেও শেষ পর্যন্ত শূন্য রানে অপরাজিত বাংলাদেশেরনাম্বার টেন তবে অধিনায়ক মুশফিককে সঙ্গ দিতে পেরেছিলেন বলেই শেষ পর্যন্ত দল পেরিয়েছে ৩০০ রানের গণ্ডি
এই মাঠে আগের টেস্টে বাংলাদেশকে প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি উপহার দেওয়া মুশফিকই আসল লোক। আবারও দেখিয়েছেন বিপর্যয়ের মধ্যে কী করে ব্যাট করতে হয়। অন্য প্রান্ত থেকে সঙ্গীদের বিদায়ের মিছিল দেখেছেন, কিন্তু তিনি থেকে গেছেন অচঞ্চল। তাঁর ওপর দিয়ে ঝড়-ঝঞ্ঝা বইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে শ্রীলঙ্কান বোলাররা। কিন্তু মুশফিককে টলানো যায়নি। প্রথম বাউন্ডারি মেরেছেন নিজের ৮৯তম বলে, যেটি ছিল দুর্ধর্ষ স্পিনার রঙ্গনা হেরাথের মাথার ওপর দিয়ে মারা ছক্কা। এরপর দৃষ্টিনন্দন সব শটে আরও ৮টি বাউন্ডারি। পৌঁছে গিয়েছিলেন নিজের ষষ্ঠ টেস্ট সেঞ্চুরির কাছে। মাত্র ১৫ রানের জন্য সেটি হয়নি। ওই হেরাথেরই বলে বোল্ড হয়েছেন অবশ্য বাজে শট খেলে। কিন্তু মুশফিককে যে তখন খেলতে হচ্ছিল দশম ব্যাটসম্যানকে আড়াল করে।
আউট হওয়ার আগে অবশ্য অধিনায়ক সতীর্থদের শিখিয়ে দিয়ে গেছেন কীভাবে টেস্ট ব্যাটিংটা করতে হয়। তাঁর কাছ থেকে যে অন্যরা শিখছেন সেটি নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছেন সৌম্য। কিন্তু কথা হলো, এই শিক্ষাপর্বটা যেন শুধু বিলম্বিতই হয়ে যাচ্ছে তাঁর সহ-ব্যাটসম্যানদের কাছে।
শ্রীলঙ্কার পরিকল্পনা ছিল সহজ-সরল। এক প্রান্তে আক্রমণাত্মক চায়নাম্যান বোলার লক্ষ্মণ সান্দাকানকে লেলিয়ে দিয়ে অন্য প্রান্তে রানের প্রবাহকে শুকিয়ে ফেলা। তাতেই বাংলাদেশের মূল ব্যাটসম্যানরা বিলিয়ে দিয়ে এলেন উইকেট। একটু অপরিচিত প্রজাতির চায়নাম্যান বোলারের নামটাও তাঁদের মনের ওপর একটা প্রভাব ফেলে থাকবে হয়তো।
ম্যাচ কাল দিনের খেলা শেষে যেখানে দাঁড়িয়ে, সেখান থেকে বাঁচতে হলে প্রকৃতির একটু আশীর্বাদ হয়তো দরকার। তা প্রকৃতি একটু বন্ধুসুলভ আচরণ করলও। মেঘ ঘনিয়ে আসায় মিনিট আগেই নিয়ে নেওয়া হয় চা-বিরতি। বিরতি শেষে মুশফিকরা আবার মাঠে খাটুনি দিতে নেমে পড়েছেন, শ্রীলঙ্কার দুই ওপেনার সীমানাদড়ির কাছে চলে এসেছেন, তখনই শুরু বৃষ্টি। খেলা আর হতে পারেনি। শেষ সেশনটা চলে গেছে মেঘ-বৃষ্টির পেটে। মেঘ আর বৃষ্টি যদি আরেকটু ক্রিকেটখেকো হয়, বাংলাদেশের জন্য সেটিই হবে ভালো। তা না হলে মুশফিকদের জন্য রচিত হবে আরেকটি সংগ্রামের কাহিনি।

তৃতীয় দিনের শেষে
শ্রীলঙ্কা ১ম ইনিংস: ৪৯৪
বাংলাদেশ ১ম ইনিংস: ৩১২

No comments:

Post a Comment

Sponsor